• ⭐⭐ মুজিববাদ মুক্তি পাক ⭐ জঙ্গিবাদ-মৌদুদীবাদ নিপাত যাক ⭐⭐ ⭐⭐ Get rid of Mujibism ⭐ Let Militantism and Maududiism die ⭐⭐

বঙ্গবন্ধু'র রাজনৈতিক জীবন বৃত্তান্ত

★ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক সক্রিয়তাঃ
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়েছিল। তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং খাদ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে বাংলা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী ঐ বছরই বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। ঐ সময় বিদ্যালয়ের ছাদ সংস্কারের দাবি নিয়ে একটি দল তাঁদের কাছে যায় এবং দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিব স্বয়ং। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয় ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে। ৭ দিন হাজতবাস করার পর তিনি ছাড়া পান। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি এবং মহকুমা মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন।

হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমান
রাজনৈতিক জীবনের শুরু- ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ।

প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়- ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ।

ম্যাট্রিকুলেশন (এনট্র্যান্স) পাশ- ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ।

বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন- ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন (এনট্র্যান্স) পাশ করার পর ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং এখানে পড়াশোনাকালীন তিনি বাংলার অগ্রণী মুসলিম নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। একই বছর কলকাতায় ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক প্রমুখের নেতৃত্বে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঐ সময় থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।

★পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংগ্রামঃ
পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

★ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো বৈঠক
বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়তাঃ
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা করেন। এতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদী শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলিম লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণকালে বঙ্গবন্ধু
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা – ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে মার্চ ।

দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আটক – ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ।

শেখ মুজিবকে জেলে আটক করে রাখা হয়- দুই বছর ।

অনশন পালন- ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি থেকে ।

অনশন কার্যকর ছিল- ১৩ দিন ।

জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়- ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি ।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে শেখ মুজিবকে আটক করা হয় এবং দুই বছর জেলে আটক করে রাখা হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি মুজিবের জেলমুক্তির আদেশ পাঠ করার কথা থাকলেও খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।” এ ঘোষণার পর জেলে থাকা সত্ত্বেও জেল থেকে নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরোক্ষভাবে পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে তিনি ভূমিকা রাখেন। এরপরই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সময়ে শেখ মুজিব জেলে অবস্থান করেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল। ২৬শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

★আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাঃ
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুন হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলে শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। কে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

★যুক্তফ্রন্ট সরকারঃ
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছরের ১৪ই নভেম্বর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ । নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিল। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নবনির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি ও বন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত- ৯ই জুলাই ১৯৫৩ ।

পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন- ১০ই মার্চ ১৯৫৪ ।

যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান- ১৫ই মে ১৯৫৪ ।

প্রথমবারের মতো গণপরিষদের সদস্য হন- ৫ই জুন ১৯৫৫ ।

মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন- ৩০শে মে ১৯৫৭ ।

৩রা এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলা প্রদেশে সরকার গঠন করে এবং ১৫ই মে শেখ মুজিব উক্ত সরকারে যোগ দিয়ে কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২৯শে মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়। ৩১শে মে করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর বিমান বন্দর থেকেই তাঁকে আটক করা হয়। ২৩শে ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন তিনি। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জুন শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো গণপরিষদের সদস্য হন। ২৫শে আগস্ট পাকিস্তানের করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে শেখ মুজিব বলেন:
স্যার (গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট), আপনি দেখবেন ওঁরা “পূর্ব বাংলা” নামের পরিবর্তে “পূর্ব পাকিস্তান” নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের বাংলা (বঙ্গ) ব্যবহার করতে হবে। “বাংলা” শব্দটার একটি নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য আছে। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবেন কিনা। এক ইউনিটের প্রশ্নটা গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটাই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নের সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাবো তারা যেন আমাদের জনগণের রেফারেন্ডাম অথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১-২৩শে অক্টোবর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেয়া হয় ও শেখ মুজিবকে পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তি সম্মেলনে যোগদান করার জন্য নয়াদিল্লি যান। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সময় ব্যয় করার জন্যে তিনি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭-৫৮ অর্থবছরের জন্য তিনি পাকিস্তান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

★ছয় দফা আন্দোলনঃ
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একে “ম্যাগনা কার্টা” বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়। ছয় দফার দাবিগুলো ছিল নিম্নরূপ

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হবে। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দুইটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে – দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
সমগ্র দেশের জন্যে দুইটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন।
ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। তবে, প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে।
অঙ্গরাষ্ট্রগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে, এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্রকে দেবে।
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
শেখ মুজিব এই দাবিকে “আমাদের বাঁচার দাবী” শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এই দাবি সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ কারণে তিনি উক্ত সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা মার্চে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন ও প্রায় পুরো দেশই ভ্রমণ করে জনসমর্থন অর্জন করেন।

১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে ১১ জন বাঙালি শহিদ হন। ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া। প্রতি বছর ৭ই জুন বাংলাদেশে ‘৬ দফা দিবস’ পালন করা হয়।

★আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাঃ
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবসহ ৩৫ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। মামলায় পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২১ ও ১৩১ ধারা অনুসারে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিবসহ এই কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে। এতে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামি করা হয় এবং পাকিস্তান বিভক্তিকরণ ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের-৩রা জানুয়ারি ১৯৬৮ ।
এক নম্বর আসামি- শেখ মুজিবুর রহমান ।
মামলাটির মোট অনুচ্ছেদ ছিল- ১০০টি ।
মামলাটির মোট ১০০টি অনুচ্ছেদ ছিল। ১১ জন রাজসাক্ষী ও ২২৭ জন সাক্ষীর তালিকা আদালতে পেশ করা হয়।এর অব্যবহিত পরেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। মামলাটিকে মিথ্যা ও বানোয়াট আখ্যায়িত করে সর্বস্তরের জনসাধারণ শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন।

★ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানঃ
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগারো দফা দাবি পেশ করে, তন্মধ্যে শেখ মুজিবের ছয় দফার সবগুলোই অন্তর্ভুক্ত ছিল। উক্ত পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। আন্দোলনটি এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। পরবর্তীতে এই গণআন্দোলনই “ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান” নামে পরিচিতি পায়।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় সম্মেলনে মুজিব তাঁর ছয়-দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দাবীগুলো উপস্থাপন করেন। কিন্তু, তা প্রত্যাখ্যাত হলে সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন তিনি। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই ডিসেম্বর শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে:

একটা সময় ছিল যখন মানচিত্র থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ‘বাংলা’ শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ বদলে ‘বাংলাদেশ’ ডাকা হবে।

★৭০-এর নির্বাচনঃ
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর (জাতীয়) ও ১৭ই ডিসেম্বর (প্রাদেশিক) “এক ব্যক্তির এক ভোটের ভিত্তিতে” নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় জাতীয় পরিষদে সদস্য সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৬৯ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৪৪ জন প্রতিনিধি থাকতেন।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ২টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ায় জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ। ১৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

★৭ই মার্চের ভাষণঃ
আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সামরিক শাসকগোষ্ঠী দলটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে-কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

৬ই মার্চ এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে সকল প্রকার দোষ তাঁর উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালান। এ ধরনের ঘোলাটে পরিস্থিতিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুলসংখ্যক লোক একত্রিত হয়। সাধারণ জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। তিনি ঘোষণা দেন –
….. রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। …

★ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো বৈঠকঃ
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১৬ই মার্চ শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ১৯শে মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব তৃতীয় দফা বৈঠক হয়। ২১শে মার্চ আলোচনায় যোগ দিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ১২ জন উপদেষ্টা ও সফরসঙ্গী ঢাকা আসেন। ২২শে মার্চ ভুট্টো-মুজিবের ৯০ মিনিটের একটি বৈঠক হয়। অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করা সত্ত্বেও ভুট্টো-মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয়নি। ২৫শে মার্চ ভুট্টো-ইয়াহিয়া রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত অপারেশন সার্চলাইট প্রদান করে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা করেন।